শিলচর শহরে সাম্প্রতিক সময়ে এক অদ্ভুত অথচ উদ্বেগজনক চিত্র সামনে এসেছে। বাজার থেকে ছোট ছোট দোকান, চা স্টল থেকে রিকশাওয়ালা – অনেকেই এখন ₹১, ₹২ ও ₹১০ টাকার কয়েন নিতে চাইছেন না। এমন এক দেশে যেখানে এই কয়েনগুলো ভারত সরকারের দ্বারা বৈধ হিসেবে স্বীকৃত, সেখানে এই আচরণ অনেক নাগরিকের দৈনন্দিন লেনদেনকে সমস্যার মুখে ফেলছে।
এই প্রবণতা শুধুই একটি-দুটি জায়গায় নয়, শিলচরের প্রায় সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। দোকানদাররা অজুহাত দিচ্ছেন – “এই কয়েন আমরা কোথাও চালাতে পারি না”, “ব্যাংক এই কয়েন নেয় না”, “খুচরো দিতে সমস্যা হয়” ইত্যাদি। ফলে সাধারণ মানুষ যারা এই কয়েন সংগ্রহ করে রেখেছেন, তাঁরা বাজারে গিয়ে অপমানিত হচ্ছেন এবং অর্থ ব্যবহার করতে না পেরে অসহায় হয়ে পড়ছেন।
এই সমস্যার মধ্যেই এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ তৈরি করলেন কাটিগড়ার যুবক সম্রাট ধর। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি এক অভিনব প্রতিবাদের পথ বেছে নেন। A4 সাইজের কাগজে “₹১, ₹২ ও ₹১০ এর কয়েন নেবেন না কেন?” – এই প্রশ্ন লিখে তিনি পুরো শিলচর শহর জুড়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। তাঁর এই উদ্যোগ নজর কাড়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমেরও।
এই প্রতিবাদের খবর প্রকাশ করেছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম Way2barak।
সম্রাট ধর বলেন, “আমার কাছে কয়েকশো ₹১০ টাকার কয়েন ছিল, আমি অনেক দোকানে গেলাম, কেউ নিল না। অপমান সহ্য করতে না পেরে আমি ঠিক করলাম শহরবাসীকে জাগিয়ে তুলবো।” তাঁর প্ল্যাকার্ডটি সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগিয়েছে — সরকার যেখানে এই কয়েন চালু রেখেছে, সেখানে আমরা কীভাবে এটি অস্বীকার করতে পারি?
বিগত বছরগুলিতে ভারতে কয়েকবার গুজব ছড়িয়েছিল যে ₹১০-এর কয়েন জাল বা বাতিল হয়েছে। যদিও ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় সরকার বহুবার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে সব ধরনের ডিজাইনের ₹১০-এর কয়েন সম্পূর্ণভাবে বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য। তা সত্ত্বেও জনসাধারণের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা থেকে এমন আচরণ সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু ₹১০ নয়, ₹১ ও ₹২-এর কয়েন নিয়েও মানুষের মধ্যে অনিচ্ছা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন এদের ওজন কম, অথবা এগুলো পুরোনো বলে চলবে না। অথচ বাস্তবে এগুলিও বাজারে বৈধ এবং প্রচলিত। এই ধরণের ভ্রান্ত ধারণা শুধু সাধারণ মানুষের জন্য নয়, খুচরো ব্যবসায়ীদের জন্যও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এখন প্রশ্ন উঠে আসে, এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? প্রথমত, প্রশাসনের উচিত দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রচারের মাধ্যমে জানানো উচিত — “কোনো বৈধ মুদ্রা অগ্রহণযোগ্য নয়”। বিশেষ করে ব্যাঙ্ক ও বাজারে যেন পরিষ্কার করে নোটিশ টাঙানো হয়।
দ্বিতীয়ত, এই ধরণের সচেতনতা মূলক প্রতিবাদ আরও ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। সম্রাট ধর-এর মতো যুবকদের উদ্যোগ জনমনে আলোড়ন তোলে এবং মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে। সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ব্লগারেরও ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে গেলে তাঁরা ছোট মূল্যমানের কয়েন জমা দিতে গেলে ফিরিয়ে দেওয়া হয় বা বিলম্ব করা হয়। ফলে মানুষ মনে করেন ব্যাংকও এই কয়েন গ্রহণ করে না। অথচ RBI-এর নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলিকে সব মূল্যমানের মুদ্রা গ্রহণ করতেই হবে।
এই পরিস্থিতিতে RBI ও জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি। নিয়ম অনুযায়ী দোকানদার বা কেউই কোনো বৈধ মুদ্রা গ্রহণে অস্বীকার করতে পারেন না। এই বিষয়ে কোনো দোকানদার আইন অমান্য করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
শিলচরের এই পরিস্থিতি আমাদের একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় — শুধুমাত্র ভুল ধারণা, গুজব ও অনভিজ্ঞতা থেকেই কীভাবে একটি শহর নিজের বৈধ মুদ্রা ব্যবহার করতে অস্বীকার করতে পারে? একদিকে যেখানে নগদ লেনদেন এখনো দেশের একটি বড় অংশে চালু রয়েছে, সেখানে এই ধরণের আচরণ অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও সামাজিক সম্মানবোধকেও আঘাত করে।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই বিষয়ে অনেক অভিযোগ আসছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ, ছোট ব্যবসায়ী ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষ যাঁরা প্রতিদিনের জীবনে এই কয়েন ব্যবহার করে থাকেন, তাঁদের জীবনে এই অমানবিকতা আরও বেশি অনুভবযোগ্য। তাঁদের অনেক সময় ও অপমান সহ্য করে লেনদেন করতে হয়।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “ছোট ছোট বাচ্চারা এখন দোকানে গেলে ₹২ বা ₹৫ দিয়ে কিছু কিনতে পারে না। দোকানদার সোজাসুজি বলে দেয়, কয়েন চলে না।” এর ফলে অভিভাবকরাও দুশ্চিন্তায় পড়ছেন।
এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য শুধু প্রশাসনিক নয়, সামাজিক উদ্যোগও জরুরি। প্রত্যেকে যদি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেয় — ‘আমি বৈধ মুদ্রা প্রত্যাখ্যান করবো না’, তবে এই সমস্যা আপনাতেই মিটে যেতে পারে।
শেষ কথায়, শিলচরের সাম্প্রতিক কয়েন অস্বীকারের ঘটনা আমাদের সচেতন করে দিচ্ছে — আইন মানা ও সামাজিক দায়িত্ব পালন উভয়ই দরকার। সম্রাট ধর-এর মতো সাহসী কণ্ঠগুলোকে আরও বেশি করে সামনে আনতে হবে, যাতে ভুল ধারণার বিরুদ্ধে সত্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে।